সুদূর অতীতে হেঁটে পবিত্র নগরী মদিনা থেকে মক্কায় যেতেন হজযাত্রীরা। ৪৫০ কিলোমিটারের এ পথ পাড়ি দিতে এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থায় ঘটে গেছে আমূল পরিবর্তন। দ্রুতগতির যানবাহন পবিত্র দুই নগরীর মধ্যে দূরত্বকেই কমিয়ে এনেছে। চলাচলকে করে তুলেছে আরও সহজ ও আরামদায়ক। সুচালো মাথার হারামাইন ট্রেন প্রায় দুই ঘণ্টায় মদিনা থেকে মক্কায় পৌঁছে দিচ্ছে যাত্রীদের। যেখানে সড়কপথে সময় লাগে এর দ্বিগুণেরও বেশি।
হারামাইন হাইস্পিড রেলওয়ে বা এইচএইচআর ট্রেন সৌদির তপ্ত মরুভূমির বুকে রীতিমতো ঝড় তোলে। ট্রেনগুলো ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩০০ কিলোমিটার গতিতে ছোটে। বিদ্যুৎ চালিত ট্রেনগুলো এ রুটে দিনে প্রায় ৫০ বার যাতায়াত করে। তবে হজের সময় এ ট্রিপের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যায়। হারামাইন ট্রেন বিশ্বের ১০টি দ্রুততম ট্রেনেরও একটি। অন্যান্য অঞ্চলও উচ্চগতির এ রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে পরিকল্পনা করছে দেশটির সরকার। জ্বালানি তেল-নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে অর্থনীতি বৈচিত্র্যময় করার লক্ষ্যে রেলসহ অবকাঠামো খাতে বিপুল পরিমাণ ব্যয় করছে সৌদি আরব। উচ্চগতির রেল নেটওয়ার্কও দেশটির ভিশন-২০৩০ পরিকল্পনার অংশ।
সৌদির পবিত্র শহর মক্কায় কেবল মুসলিমরাই যেতে পারেন। তবে অন্যান্য ভ্রমণকারীও হারামাইনের ভ্রমণ উপভোগ করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তাঁরা সৌদির লোহিত সাগরের উপকূলরেখার একটি অংশ বরাবর এ ট্রেনে যাত্রা করতে পারেন।
আরবি শব্দ হারামাইন অর্থ ‘দুটি অভয়ারণ্য’। পবিত্র শহর মক্কা ও মদিনাকে সংযুক্ত করায় এই রেল নেটওয়ার্কের নাম দেওয়া হয়েছে হারামাইন। ২০১৮ সালে চালু করা এ ট্রেন সৌদির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর জেদ্দার বিমানবন্দর, শহরটির সিটি সেন্টারের কাছে জেদ্দা আল-সুলায়মানিয়াহ ও কিং আবদুল্লাহ ইকোনমিক সিটিকেও সংযুক্ত করে। খুব সহজেই হারামাইন ট্রেনের টিকিট কিনতে পারেন যাত্রীরা। গুগল প্লে স্টোরে থাকা এইচএইচআর ট্রেন নামে মোবাইল অ্যাপটি ইংরেজি ও আরবি উভয় ভাষায় ব্যবহার করা যায়। অ্যাপে ট্রেনের লে-আউট দেখা যায়। সেখানে যাত্রীরা জানালার পাশে কিংবা মাঝের আসন বেছে নিতে পারেন। পাশাপাশি যাত্রীরা ট্রেনের গতির অভিমুখে বসতে চান কিনা, সেটাও নির্ধারণ করতে পারেন। ট্রেনে প্রতিটি সিটে আলাদা টিভিও রয়েছে। অ্যানিমেশন সিরিজ পো প্যাট্রল, ফর্মুলা ই রেসিং কিংবা ইসলামিক ওয়াজের বাইরে সেখানে কিছু দেখার সুযোগ নেই। তবে বিশেষ করে সংক্ষিপ্ত যাত্রায় টিভির পরিবর্তে জানালার বাইরে মরুভূমির ধুলোময় দৃশ্য দেখা ভালো বিকল্প হতে পারে।
সিএনএন জানায়, ট্রেনের ইকোনমি ক্লাসে দু’পাশে দুটি করে আসন থাকে। অর্ধেক আসন থাকে সামনের দিকে এবং অর্ধেক পেছনের দিকে। বিজনেস ক্লাসে আসনগুলো একপাশে দুটি এবং অন্যপাশে একক আসন দিয়ে সাজানো। উচ্চগতিতে চলার সময়েও ট্রেনটি শান্ত এবং রাইডটি মসৃণ মনে হবে। পুরো লাইনে কোনো আকস্মিক বাঁক বা ঝাঁকুনি নেই।
মদিনা থেকে মক্কার স্টেশনগুলোও আধুনিক ও ঝকঝকে। তবে নিউইয়র্ক বা প্যারিসের মতো মানুষে ঠাসা নয়; কিছুটা নীরব। যাত্রীরা স্টেশনের চেয়ে আশপাশের স্থানগুলোয় সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করেন। যদিও ট্রেনের ভেতরের অভিজ্ঞতা উচ্ছ্বাসপূর্ণ ও জীবন্ত।
হজযাত্রীরা এ রেল নেটওয়ার্কের ব্যবসাকে চাঙ্গা করে তুলেছেন। সৌদি গেজেট অনুসারে, হজযাত্রীদের জন্য ট্রেনের টিকিটের চাহিদা এত বেশি থাকে যে এইচএইচআর রমজান মাসে প্রতিদিন শতাধিক ট্রিপ চালায়। চলতি বছরে হজের জন্য মার্চের মাঝামাঝি থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত এ হজযাত্রা চলছে। অন্যান্য সময়ও ওমরাহ যাত্রীদের জন্য পূর্ণ থাকে হারামাইন।
গত বছরের জানুয়ারিতে সৌদি আরবের বিনিয়োগমন্ত্রী খালিদ আল-ফালিহ সারাদেশে আট হাজার কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা ঘোষণা দিয়েছিলেন। দেশটি যেভাবে রেল নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করে চলেছে, তাতে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই রাজধানী শহর রিয়াদ থেকে জেদ্দা পর্যন্ত বুলেট ট্রেনের দেখা মিলতে পারে।
পাঠকের মতামত